ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই
আমাদের বন্ধুদের মাঝে বেশ দূরত্ব
তৈরী হয়। কারন এক সময় যারা খুব
কাছাকাছি ছিলাম তারা তখন
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে গেছি। চাইলেও একসাথে
সময় কাটাতে পারিনা।সে কারনেই
বোধহয় গৎবাধা ছুটিগুলোতে সবাই
যখন
একত্র হই তখন তুমুল আড্ডা চলে।
সারারাত
একসাথে কোন একজনের বাড়িতে
বসে
চলে আড্ডাবাজি। কখনো সখনো তাস
নিয়ে রাত পারি দেই। এমনি এক
আড্ডাতে এসেছিলো ছেলেটা।
জেমসের(আমার জনৈক বন্ধু) খালাত
কিংবা মামাত ভাই। সেদিন ছিল
ঘোর অমাবস্যা, আড্ডা সবে জমে
উঠেছে। এমন সময় লোডশেডিং। কি
আর
করা সবাই মিলে ছাদে গেলাম।
কিন্তু
আড্ডা আর জমেনা। একে তো
লোডশেডিং তায় আবার অমাবস্যা
নিজের হাতটা আবছাভাবে দেখা
যায় কি যায় না। কেউ কাউকে না
দেখে কি আর আড্ডা জমে? হঠাৎ কে
যেন বলল ভূতের গল্পের আসরের জন্য
এর
চেয়ে আদর্শ পরিবেশ আর হয়না। সবাই
রাজি। কিন্তু দেখা গেল সবাই
শ্রোতা হতে আগ্রহী, কথক হতে রাজি
নেই কেউ। হঠাৎই জেমসের সেই
ভাইটি
(তার নামটা ভুলে গেছি। অনেক
চেষ্টা করেও আজ মনে করতে
পারছিনা) বলল ,আমি একটা ঘটনা
বলি
আমার নিজের জীবনের ঘটনা। সবাই
বাহবা বাহবা করে উঠল। ছেলেটা
গল্প
শুরু করার পর বুঝলাম গল্পকথক হিসাবে
তার কোন জুড়ি নেই। আমি তার
জবানীতেই ঘটনাটা লিখছি-
ছোটবেলা থেকেই আমি উৎসবপ্রিয়
মানুষ। এখনও শতব্যস্ততার মাঝেও
সামাজিক বা পারিবারিক যে কোন
উৎসবের গন্ধ পেলেই আমি হাজির
হয়ে
যাই।যখনকার ঘটনা বলছি, তখন আমি
মাত্র এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছি।
হাতে অফুরন্ত সময় অন্তত তখন তাই
মনে
হয়েছিল। কোথায় যাব, কিভাবে এই
দীর্ঘ ছুটি কাটাব সেই দুশ্চিন্তায়
রাতের ঘুম হারাম হওয়ার দশা। এমন
সময়
বিনা বসন্তে দখিনা হাওয়া এল সুখবর
নিয়ে। খালাতো বোনের বিয়ে।
গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে বিয়ের
সাতদিন আগে হাজির হলাম খালার
বাড়ি। খালাদের গ্রামের নাম
দেওগাঁ। দেওগাঁ নামটাই কেমন
রোমাঞ্চকর। কেমন ভূতুড়ে একটা
সোদাগন্ধ যেন লুকিয়ে আছে
নামটাতে। একেত দেও-দৈত্যের
নামে
নাম তাতে আবার গ্রামে রয়েছে
একটা গণকবর। একটু ভয় ভয়ই লাগছিল।
এখন
যদিও ভূতটুতে আমার বিশ্বাস নেই,
কিন্তু সেই সময়টায় ভূতের ভয় ছিল
ভীষণ।
আর কপালটাও এমন গণকবর খালার
বাড়ির
সাথেই। খালাদের দখিন দুয়ারি ঘর।
ঘরের সামনে বিশাল আঙিনা
,আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘খলু’।
এই
খলুর বামপাশেই সেই গণকবর। ১৯৭১
সালে
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি
আর্মি
আর পূর্ব পাকিস্তানের কিছু
জানোয়ার
মিলে এই গ্রামের প্রায় পঞ্চাশ-
ষাটজন
নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে এই
গণকবরে পুঁতে রাখে।
যাই হোক, বাড়িটাকে বিয়েবাড়ির
সাজে সাজাতে টানা চার পাঁচটা
দিন হালের বলদের মত খাটলাম।
ব্যস্ততার কারণে গণকবরের কথা বা
দেওগাঁয়ের দৈত্যদেওদের কথা
ভাববার অবকাশ পাইনি। ফলে ভূতের
ভয়টা মনে জায়গা পায়নি এই ক’দিন।
ঝামেলাটা হল বিয়ের দিন রাতে।
সেরাতে বরপক্ষ আর আমাদের
আত্মীয়স্বজন মিলে এত বেশী লোক
হল
যে আমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে
শোওয়ার একটু জায়গা পেলাম না।
কারণ কাজ-টাজ শেষ করে যখন ঘুমুতে
গেছি তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে
আর ঘরের খাট পালঙ্ক এমনকি
মেঝেতেও ঘুমন্ত মানুষের ভীড়ে তিল
ধারনের জায়গা নেই। কাজেই বাড়ির
সামনের খলুতে ঘুমানোর আয়োজন
করা
হল। সব খালাত-মামাত ভাইয়েরা
সেখানে শুয়ে পড়লাম। গরমের দিন
ছিল
কাজেই খোলা আকাশের নিচে
ঘুমানোটা বেশ আরামদায়কই হওয়ার
কথা। যদিও প্রথমটায় আমি আপত্তি
তুলেছিলাম তবে তা যতটা না খোলা
আকাশের নিচে শোওয়ার
কুণ্ঠাবোধের কারণে তারচেয়ে
বেশী পাশের গণকবরের ভয়ে।
যাইহোক
দয়া-দরুদ পড়ে চোখ বন্ধ করে গণকবরের
দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের
কারণে
খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষন পরে
জানিনা ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রথমে
বুঝতে পারলাম না কেন ঘুম ভাঙল।
তারপরই অনুভব করলাম প্রচণ্ড শীত। মে
মাসের মাঝামাঝি সময়ে এমন প্রচণ্ড
শীত হওয়ার কথা নয়। সময় টময় নিয়ে
মাথা ঘামাবার চেষ্টাও করলাম না
শুধু
বুঝলাম ঘরে যেতে হবে এখানে
থাকলে শীতে জমে যাব। পাশে শুয়ে
থাকা মামাত ভাইয়ের দিকে
তাকিয়ে দেখি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
ডেকে লাভ নেই জানি। তাই ধাক্কা
দিয়ে উঠাব ভেবে উঠে বসলাম।
এমনিতেই গণকবরটার দিকে চোখ
পড়ল।
দেখলাম একটা বাচ্চাছেলে আর
দুইটা
লোক সেখানে হাঁটছে। গ্রামের
মানুষ
এমনিতেই ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম
সারে আর সেদিন তো বাড়িতে
অনেক মানুষ।বিয়ে বাড়িরই কেউ
ভেবে আর গুরুত্ব দিলাম না। যদিও
একবার তাকিয়েই আমি মুখ ফিরিয়ে
নিয়ে মামাতো ভাইকে ধাক্কাতে
শুরু করেছি কিন্তু মনের মধ্যে একটা
অস্বস্তি খোঁচা দিতে লাগল।
কোথায়
যেন একটা অসংগতি। চোখে পড়েছে
কিন্তু মন ধরতে পারছেনা। হঠাৎ
অস্বস্তিটা ভয়ে পরিণত হল। কারণ
অসংগতিটা আমি ধরতে পেরেছি।
প্রচণ্ড ভয়ে চাচ্ছি ওদিক থেকে মুখ
ফিরিয়ে রাখতে আবার দুনির্বার এক
কৌতুহল আমাকে টানছে সেদিকে।
আসলে যা ভাবছি তাই ঘটছে কীনা
তা জানার একটা প্রবল ইচ্ছা মাথা
তুলে দাঁড়াচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়,
ভয়
হার মানল কৌতুহলের কাছে। আমি
তাকালাম আবার সেই গণকবরের
দিকে।
তাকিয়েই আমার সারা শরীর অসার
হয়ে গেল। এমন ভয়াবহ দৃশ্য বা ভয়ানক
আতঙ্কের মুখোমুখি আমি আগে
কখনো
হইনি। ছোটবেলায় একবার পুকুরে পড়ে
গিয়েছিলাম। নাকে মুখে পানি ঢুকে
একাকার অবস্থা। আমার ঠিক সেই
ডুবে
যাওয়ার মত অনুভূতি হতে লাগল। মনে
হল
আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।
ভয়ে চিৎকার দিতে চাইছিলাম,
পেরেছিলাম কি না জানিনা কারণ
তার পরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি
আমি। জ্ঞান ফিরে অনেক জ্বর
নিয়ে।
এই জ্বর আর মনের ভয় দুটো কাটাতেই
আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।
এই পর্যন্ত বলে ছেলেটা থামল। হয়ত
দম
নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা ধৈর্যহীন
শ্রোতাগন একযোগে চেঁচিয়ে
উঠলাম,
‘কী দেখেছিলে?’ একটা দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে সে আবার শুরু করল-
সেদিন রাতে কী দেখেছিলাম তা
কখনই পুরোপুরি মনে করতে পারিনি।
ভাসাভাসা যা মনে আছে তা হল-
আমি গণকবরটার দিকে তাকিয়ে
দেখার পর যে অসংগতিটা মনের
মধ্যে
খোঁচা মারে তা হল যে দুজন লোক
দেখেছি তাদের মাথা নেই শুধু ধড়টা
আছে। পরেরবার যখন তাকাই তখন
দেখি
অনেকগুলো মানুষ সেখানে ঘুরছে।
তাদের বেশীরভাগেরই মাথা নেই।
কারোকারো মাথা ঘাড়ের সাথে
ঝুলে আছে যেন কেও তাদেরকে গরুর
মত
করে জবাই করেছে। সেখানে কিছু
বাচ্চাও ছিল তবে তাদের কারোরই
পুরো শরীরটা নেই। অর্ধেকটা আছে।
উপর বা নিচের অর্ধেক নয় ডান বা
বামের অর্ধেক যেন কেউ তাদেরকে
মাঝখান দিয়ে ফেঁড়ে দিয়েছে।
এছাড়া আরও অনেক কিছু- অনেক
ভয়ংকর
কিছু দেখেছিলাম এই ব্যাপারে আমি
নিশ্চিত কিন্তু এর বেশী আর কিছু
অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি
নি।
এই ঘটনার পর পাঁচ ছয় বছর পেরিয়ে
গেছে। এই ছয় বছরে অনেক কিছু
শিখেছি জেনেছি। অনেক
অবাঞ্চিত
ভয় বিশ্বাস মন থেকে দূর হয়েছে।
সেদিনের এই ঘটনাকে এখন আমি
অনায়াসেই ক্লান্ত মনের
হ্যালুসিনেশন বলতে পারতাম,
যেহেতু
তখন ভূতের ভয় প্রবল ছিল। সেটা
পারিনা দুটো প্রশ্নের উত্তর জানা
নেই বলে।
এক. জায়গাটা হঠাৎ করে এত ঠাণ্ডা
হয়ে গিয়েছিল কেন??
দুই. গণকবরের মৃতদের কথা উঠলেই গুলি
খেয়ে মারা যাওয়া একদল মানুষের
অর্ধগলিত লাশের ছবি চোখে ভাসে।
হ্যালুসিনেশনেও তেমন কিছুই দেখার
কথা। অথচ আমি দেখেছি জবাই করা
মানুষ। যদিও আমি এই ঘটনার আগে
জানতামই না ওই গণকবরে যাদের পুঁতে
রাখা হয়েছে তাদেরকে জবাই করে
হত্যা করা হয়েছিল। আর ছোট
বাচ্চাদের দুই পা দু’দিক থেকে টেনে
মাঝখান দিয়ে ফেঁড়ে ফেলা
হয়েছিল। আমার মন যা জানতই না তা
হ্যালুসিনেশন দেখা কি সম্ভব??
সেদিন যা দেখেছিলাম তা সত্যি
দেখেছিলাম না কি হ্যালুসিনেসন
ছিল জানি না। তোমাদের যা মনে
হয়
ভেবে নিও।
ঘটনাটা আমাদের মধ্যে কয়জন
বিশ্বাস
করেছিল আর কয়জন বিশ্বাস করেনি
তা
জানিনা তবে এটুকু মনে আছে
ছেলেটা গল্প শেষ করার পর কেউ আর
এক সেকেন্ডও ছাদে থাকতে রাজি
ছিলনা।
আমাদের বন্ধুদের মাঝে বেশ দূরত্ব
তৈরী হয়। কারন এক সময় যারা খুব
কাছাকাছি ছিলাম তারা তখন
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে গেছি। চাইলেও একসাথে
সময় কাটাতে পারিনা।সে কারনেই
বোধহয় গৎবাধা ছুটিগুলোতে সবাই
যখন
একত্র হই তখন তুমুল আড্ডা চলে।
সারারাত
একসাথে কোন একজনের বাড়িতে
বসে
চলে আড্ডাবাজি। কখনো সখনো তাস
নিয়ে রাত পারি দেই। এমনি এক
আড্ডাতে এসেছিলো ছেলেটা।
জেমসের(আমার জনৈক বন্ধু) খালাত
কিংবা মামাত ভাই। সেদিন ছিল
ঘোর অমাবস্যা, আড্ডা সবে জমে
উঠেছে। এমন সময় লোডশেডিং। কি
আর
করা সবাই মিলে ছাদে গেলাম।
কিন্তু
আড্ডা আর জমেনা। একে তো
লোডশেডিং তায় আবার অমাবস্যা
নিজের হাতটা আবছাভাবে দেখা
যায় কি যায় না। কেউ কাউকে না
দেখে কি আর আড্ডা জমে? হঠাৎ কে
যেন বলল ভূতের গল্পের আসরের জন্য
এর
চেয়ে আদর্শ পরিবেশ আর হয়না। সবাই
রাজি। কিন্তু দেখা গেল সবাই
শ্রোতা হতে আগ্রহী, কথক হতে রাজি
নেই কেউ। হঠাৎই জেমসের সেই
ভাইটি
(তার নামটা ভুলে গেছি। অনেক
চেষ্টা করেও আজ মনে করতে
পারছিনা) বলল ,আমি একটা ঘটনা
বলি
আমার নিজের জীবনের ঘটনা। সবাই
বাহবা বাহবা করে উঠল। ছেলেটা
গল্প
শুরু করার পর বুঝলাম গল্পকথক হিসাবে
তার কোন জুড়ি নেই। আমি তার
জবানীতেই ঘটনাটা লিখছি-
ছোটবেলা থেকেই আমি উৎসবপ্রিয়
মানুষ। এখনও শতব্যস্ততার মাঝেও
সামাজিক বা পারিবারিক যে কোন
উৎসবের গন্ধ পেলেই আমি হাজির
হয়ে
যাই।যখনকার ঘটনা বলছি, তখন আমি
মাত্র এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছি।
হাতে অফুরন্ত সময় অন্তত তখন তাই
মনে
হয়েছিল। কোথায় যাব, কিভাবে এই
দীর্ঘ ছুটি কাটাব সেই দুশ্চিন্তায়
রাতের ঘুম হারাম হওয়ার দশা। এমন
সময়
বিনা বসন্তে দখিনা হাওয়া এল সুখবর
নিয়ে। খালাতো বোনের বিয়ে।
গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে বিয়ের
সাতদিন আগে হাজির হলাম খালার
বাড়ি। খালাদের গ্রামের নাম
দেওগাঁ। দেওগাঁ নামটাই কেমন
রোমাঞ্চকর। কেমন ভূতুড়ে একটা
সোদাগন্ধ যেন লুকিয়ে আছে
নামটাতে। একেত দেও-দৈত্যের
নামে
নাম তাতে আবার গ্রামে রয়েছে
একটা গণকবর। একটু ভয় ভয়ই লাগছিল।
এখন
যদিও ভূতটুতে আমার বিশ্বাস নেই,
কিন্তু সেই সময়টায় ভূতের ভয় ছিল
ভীষণ।
আর কপালটাও এমন গণকবর খালার
বাড়ির
সাথেই। খালাদের দখিন দুয়ারি ঘর।
ঘরের সামনে বিশাল আঙিনা
,আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘খলু’।
এই
খলুর বামপাশেই সেই গণকবর। ১৯৭১
সালে
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি
আর্মি
আর পূর্ব পাকিস্তানের কিছু
জানোয়ার
মিলে এই গ্রামের প্রায় পঞ্চাশ-
ষাটজন
নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে এই
গণকবরে পুঁতে রাখে।
যাই হোক, বাড়িটাকে বিয়েবাড়ির
সাজে সাজাতে টানা চার পাঁচটা
দিন হালের বলদের মত খাটলাম।
ব্যস্ততার কারণে গণকবরের কথা বা
দেওগাঁয়ের দৈত্যদেওদের কথা
ভাববার অবকাশ পাইনি। ফলে ভূতের
ভয়টা মনে জায়গা পায়নি এই ক’দিন।
ঝামেলাটা হল বিয়ের দিন রাতে।
সেরাতে বরপক্ষ আর আমাদের
আত্মীয়স্বজন মিলে এত বেশী লোক
হল
যে আমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে
শোওয়ার একটু জায়গা পেলাম না।
কারণ কাজ-টাজ শেষ করে যখন ঘুমুতে
গেছি তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে
আর ঘরের খাট পালঙ্ক এমনকি
মেঝেতেও ঘুমন্ত মানুষের ভীড়ে তিল
ধারনের জায়গা নেই। কাজেই বাড়ির
সামনের খলুতে ঘুমানোর আয়োজন
করা
হল। সব খালাত-মামাত ভাইয়েরা
সেখানে শুয়ে পড়লাম। গরমের দিন
ছিল
কাজেই খোলা আকাশের নিচে
ঘুমানোটা বেশ আরামদায়কই হওয়ার
কথা। যদিও প্রথমটায় আমি আপত্তি
তুলেছিলাম তবে তা যতটা না খোলা
আকাশের নিচে শোওয়ার
কুণ্ঠাবোধের কারণে তারচেয়ে
বেশী পাশের গণকবরের ভয়ে।
যাইহোক
দয়া-দরুদ পড়ে চোখ বন্ধ করে গণকবরের
দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের
কারণে
খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষন পরে
জানিনা ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রথমে
বুঝতে পারলাম না কেন ঘুম ভাঙল।
তারপরই অনুভব করলাম প্রচণ্ড শীত। মে
মাসের মাঝামাঝি সময়ে এমন প্রচণ্ড
শীত হওয়ার কথা নয়। সময় টময় নিয়ে
মাথা ঘামাবার চেষ্টাও করলাম না
শুধু
বুঝলাম ঘরে যেতে হবে এখানে
থাকলে শীতে জমে যাব। পাশে শুয়ে
থাকা মামাত ভাইয়ের দিকে
তাকিয়ে দেখি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
ডেকে লাভ নেই জানি। তাই ধাক্কা
দিয়ে উঠাব ভেবে উঠে বসলাম।
এমনিতেই গণকবরটার দিকে চোখ
পড়ল।
দেখলাম একটা বাচ্চাছেলে আর
দুইটা
লোক সেখানে হাঁটছে। গ্রামের
মানুষ
এমনিতেই ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম
সারে আর সেদিন তো বাড়িতে
অনেক মানুষ।বিয়ে বাড়িরই কেউ
ভেবে আর গুরুত্ব দিলাম না। যদিও
একবার তাকিয়েই আমি মুখ ফিরিয়ে
নিয়ে মামাতো ভাইকে ধাক্কাতে
শুরু করেছি কিন্তু মনের মধ্যে একটা
অস্বস্তি খোঁচা দিতে লাগল।
কোথায়
যেন একটা অসংগতি। চোখে পড়েছে
কিন্তু মন ধরতে পারছেনা। হঠাৎ
অস্বস্তিটা ভয়ে পরিণত হল। কারণ
অসংগতিটা আমি ধরতে পেরেছি।
প্রচণ্ড ভয়ে চাচ্ছি ওদিক থেকে মুখ
ফিরিয়ে রাখতে আবার দুনির্বার এক
কৌতুহল আমাকে টানছে সেদিকে।
আসলে যা ভাবছি তাই ঘটছে কীনা
তা জানার একটা প্রবল ইচ্ছা মাথা
তুলে দাঁড়াচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়,
ভয়
হার মানল কৌতুহলের কাছে। আমি
তাকালাম আবার সেই গণকবরের
দিকে।
তাকিয়েই আমার সারা শরীর অসার
হয়ে গেল। এমন ভয়াবহ দৃশ্য বা ভয়ানক
আতঙ্কের মুখোমুখি আমি আগে
কখনো
হইনি। ছোটবেলায় একবার পুকুরে পড়ে
গিয়েছিলাম। নাকে মুখে পানি ঢুকে
একাকার অবস্থা। আমার ঠিক সেই
ডুবে
যাওয়ার মত অনুভূতি হতে লাগল। মনে
হল
আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।
ভয়ে চিৎকার দিতে চাইছিলাম,
পেরেছিলাম কি না জানিনা কারণ
তার পরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি
আমি। জ্ঞান ফিরে অনেক জ্বর
নিয়ে।
এই জ্বর আর মনের ভয় দুটো কাটাতেই
আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।
এই পর্যন্ত বলে ছেলেটা থামল। হয়ত
দম
নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা ধৈর্যহীন
শ্রোতাগন একযোগে চেঁচিয়ে
উঠলাম,
‘কী দেখেছিলে?’ একটা দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে সে আবার শুরু করল-
সেদিন রাতে কী দেখেছিলাম তা
কখনই পুরোপুরি মনে করতে পারিনি।
ভাসাভাসা যা মনে আছে তা হল-
আমি গণকবরটার দিকে তাকিয়ে
দেখার পর যে অসংগতিটা মনের
মধ্যে
খোঁচা মারে তা হল যে দুজন লোক
দেখেছি তাদের মাথা নেই শুধু ধড়টা
আছে। পরেরবার যখন তাকাই তখন
দেখি
অনেকগুলো মানুষ সেখানে ঘুরছে।
তাদের বেশীরভাগেরই মাথা নেই।
কারোকারো মাথা ঘাড়ের সাথে
ঝুলে আছে যেন কেও তাদেরকে গরুর
মত
করে জবাই করেছে। সেখানে কিছু
বাচ্চাও ছিল তবে তাদের কারোরই
পুরো শরীরটা নেই। অর্ধেকটা আছে।
উপর বা নিচের অর্ধেক নয় ডান বা
বামের অর্ধেক যেন কেউ তাদেরকে
মাঝখান দিয়ে ফেঁড়ে দিয়েছে।
এছাড়া আরও অনেক কিছু- অনেক
ভয়ংকর
কিছু দেখেছিলাম এই ব্যাপারে আমি
নিশ্চিত কিন্তু এর বেশী আর কিছু
অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি
নি।
এই ঘটনার পর পাঁচ ছয় বছর পেরিয়ে
গেছে। এই ছয় বছরে অনেক কিছু
শিখেছি জেনেছি। অনেক
অবাঞ্চিত
ভয় বিশ্বাস মন থেকে দূর হয়েছে।
সেদিনের এই ঘটনাকে এখন আমি
অনায়াসেই ক্লান্ত মনের
হ্যালুসিনেশন বলতে পারতাম,
যেহেতু
তখন ভূতের ভয় প্রবল ছিল। সেটা
পারিনা দুটো প্রশ্নের উত্তর জানা
নেই বলে।
এক. জায়গাটা হঠাৎ করে এত ঠাণ্ডা
হয়ে গিয়েছিল কেন??
দুই. গণকবরের মৃতদের কথা উঠলেই গুলি
খেয়ে মারা যাওয়া একদল মানুষের
অর্ধগলিত লাশের ছবি চোখে ভাসে।
হ্যালুসিনেশনেও তেমন কিছুই দেখার
কথা। অথচ আমি দেখেছি জবাই করা
মানুষ। যদিও আমি এই ঘটনার আগে
জানতামই না ওই গণকবরে যাদের পুঁতে
রাখা হয়েছে তাদেরকে জবাই করে
হত্যা করা হয়েছিল। আর ছোট
বাচ্চাদের দুই পা দু’দিক থেকে টেনে
মাঝখান দিয়ে ফেঁড়ে ফেলা
হয়েছিল। আমার মন যা জানতই না তা
হ্যালুসিনেশন দেখা কি সম্ভব??
সেদিন যা দেখেছিলাম তা সত্যি
দেখেছিলাম না কি হ্যালুসিনেসন
ছিল জানি না। তোমাদের যা মনে
হয়
ভেবে নিও।
ঘটনাটা আমাদের মধ্যে কয়জন
বিশ্বাস
করেছিল আর কয়জন বিশ্বাস করেনি
তা
জানিনা তবে এটুকু মনে আছে
ছেলেটা গল্প শেষ করার পর কেউ আর
এক সেকেন্ডও ছাদে থাকতে রাজি
ছিলনা।
No comments:
Post a Comment