Friday, April 17, 2015

ভুতের গল্প - ৩

আমি শাহিন
তখন চলতে ছিল আষাঢ় মাস। আষাঢ়
মাস ভ্রমনের জন্য মোটেও সুবিধার
নয়। যখন তখন বৃষ্টির ফলে রাস্তা-ঘাট
কাদায় সয়লাব হয়ে থাকে। তারপরও
আমাকে যেতে হয়েছিল। কথা ছিল
ভ্রমন সংঙ্গি হিসাবে আমার
বাল্যবন্ধু ইমরান থাকবে। কিন্তু
যাবার আগের দিন ইমরান আমাকে
চৌধুরী সাহেবের বাড়ি যাবার
বিস্তারিত ঠিকানাটা হাতে
ধরিয়ে দিল। করুন গলায় বললো, দোস্ত
প্লিজ তুই একা গিয়ে ঘুরে আয়। আমার
অফিসের জরুরী কাজে আমাকে
চট্রগ্রাম যেতে হবে। কণে তোর পছন্দ
হলে পরের বার আমি আর তুই যাব।
ওর এমন অনায্য দাবী শুনে আমি যেন
আকাশ থেকে পড়লাম। সাথে সাথে
তির্ব প্রতিবাদ করে বললাম, এটা
তোর খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুই
জানিস আমি কেমন। আমার পক্ষে
কিছুতেই অপরিচিত জায়গায় একা
যাওয়া সম্ভব নয়। আর নিজের পাত্রী
দেখতে যাব নিজেই! ছিঃ কেউ একা
কণে দেখতে যায়?
আমার ভৎসনায় ওরে খুব বিচলিত
দেখায়। ও ভাল করেই জানে
মেয়েদের ব্যাপারে আমার
সিমাহিন অস্বস্তির কথা। ২৮ বছর
পেরিয়ে যাবার পরও মেয়েদের
ব্যাপারে আমার লাজুকতা ভয়াবহ
পর্যায়ে। কিন্তু ইমরানের নানা
যুক্তির কাছে, আর সারা জীবনের
সবচেয়ে কাছের বন্ধুর দাবীর কাছে
পরাজয় হয় সব কিছুর। আমি গিয়ে
ছিলাম কুসুমপুর। তার গল্পই বলব আজ।
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। রেলের
কাচের জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টি
দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম আমি
জানিনা। রেল যখন ঝাকুনি দিয়ে
থামল ধরমর করে উঠলাম। ততক্ষনে
বেশিরভাগ যাত্রী নেমে গিয়েছে।
বৃষ্টিপাত তখনও চলতেছিল। দৌড়ে
প্লাটফর্মে ঢুকলাম বটে তবে শরীরের
বেশ কিছুটা ভিজে গেল আষাঢ়ের
বৃষ্টিতে। ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষের
সামনে দাড়িয়ে ভিজে যাওয়া
চশমার গ্লাস পরিস্কার করলাম। কেমন
যেন ঝাপসা দেখছি সব। মাথাটাও
ঝিমঝিম করছে। টানা সাত ঘন্টার
রেল ভ্রমনের ক্লান্তিতে এমনটা
হয়েছে বোধহয়।
ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষটা বহুদিন
চুনকাম করা হয়নি। অনেক জায়গায়
প্লাস্টার উঠে গিয়ে লাল ইট
বেরিয়ে আছে। স্যাতসেতে দেয়াল।
ষ্টেশন মাষ্টারের চেয়ারের বাম
পাশে একটা কাঠের আলমারী।
আলমারীর দরজা আটকানো থাকলেও
আলমারীর উপরে পুরাতন রেজিষ্টার
খাতা আর ময়লা ফাইলের স্তুব।
ষ্টেশন মাষ্টারের চেয়ারের একটা
হাতল নেই। তেল চিটচিটে হয়ে
চেয়ারটা তার আসল চেহারাটা
হারিয়ে ফেলেছে। ভদ্রলোকের
গায়ের রং কালো। বয়স ৫০বছরের
বেশি হবে। গালে বিশ্রি একটা
কাটা দাগ। তবে গোফটা বেশ ভারি।
যতœ করে গোফটাকে কামিয়েছেন
ষ্টেশন মাষ্টার।
আমি তাকে সালাম দিলাম । তিনি
বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে
তাকালেন। টাই পরা সুশ্রী আমাকে
অন্যরা সমিহ করলেও তিনি আমাকে
যেন খেয়ালই করতে চাইল না। গলা
পরিস্কার করে আমি তাকে কিছু
বলতে গেলাম ঠিক তখনি সে মাথা
ঘুরিয়ে বললো, ঢাকার ট্রেন
আগামীকাল সকাল ৯টায়।
- আমি কিছুক্ষন আগের ট্রেনে ঢাকা
হতে এসেছি। এসেই একটা ভয়ানক
সমস্যায় পড়েছি। কথা ছিল শরিফ
চৌধুরীর লোকজন আমার জন্য গাড়ি
নিয়ে অপেক্ষা করবেন। কিন্তু এখন
ষ্টেশনে কাউকে খুজে পাচ্ছিনা।
এমনকি কোথাও একটা রিকশাও
পেলাম না।
আমার কণ্ঠে অসহয়ত্ব প্রকাশ পেলো।
কিন্তু ষ্টেশন মাষ্টার বেশ
নির্বিকার ভাবে বললো, জমিদারী
চলে গিয়েছে ৪০ বছর আগে, কিন্তু
ওনার ডাট কমে নাই!
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম ষ্টেশন
মাষ্টারের ধৃষ্টতা দেখে।
বিস্ফোরিত চোখে প্রশ্ন করলাম, কি
বলছেন এসব? আমার কথার উত্তর না
দিয়ে তিনি বললেন, চৌধুরী
সাহেবের বাড়িতো মহল্লার শেষ
মাথায়। তাছাড়া দু’দিন ধরে
যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে রাস্তায়
হাটু পানি জমে গেছে। চৌধুরী
সাহেব আপনার জন্য একটা রিকশা
পাঠিয়ে ছিলেন, তবে রেল দুই ঘন্টা
লেট করে আসায় আর তুফান থাকায়
সে হয়ত চলে গিয়েছে।
আমি হাতঘড়িতে চোখ রাখলাম, রাত
১০টা বেজে ৩৬ মিনিট। গ্রামে অবশ্য
সাড়ে দশটাই অনেক রাত। আর সেটা
যদি হয় ঝড় বৃষ্টির রাত!
ওয়েটিং রুমের বেঞ্চিতে এসে বসে
পড়লাম। ভারি ক্লান্তি লাগছে।
পেটের ভেতর খিদেরাও আক্রমন
চালাতে শুরু করে দিয়েছে। অসহ্য
লাগতে ছিল। বুঝতে পারছিলাম না
কি করে এই অনাকাঙ্খিত বিপদ হতে
উদ্ধার পাবো। বন্ধু ইমরানের
চৌদ্দ্যগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলাম।
বার বার ঘড়ি দেখতে ছিলাম।
সেকেন্ডের কাটা গুলি যেন ঘন্টার
কাঠা হয়ে গেল, সময় কাটতে চাইছিল
না। তারপরও বসে বসে একঘন্টা
কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু বৃষ্টি থামার
কোন লক্ষন দেখলাম না। দেয়ালের
পেরেকের সাথে হারিকেন ঝুলিয়ে
রাখা হয়েছে। বাতাসে
হারিকেনের
আলো কাঁপছে। ঘোলা কাচের ভেতর
থেকে লাল ফ্যাকাসে আলো গভির
অন্ধকারের কাছে তেমন পাত্তা
পাচ্ছেনা।
ওয়েটিং রুমে এখন আর কেউ নেই
আমি ছাড়া। বাইরের বৃষ্টির শব্দ আর
রাতের নিঃসঙ্গ নিজর্ণতা মিলে
ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
আমার গা ছমছম করছিল। ভয়
পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল অচেনা
পৃথীবিতে চলে এসেছি আমি।
জানালা দিয়ে বাইরের নিকষ
কালো অন্ধকার ঘরে ঢুকছে। ভয়াবহ
এমন সময়ে হঠাৎ মনে পড়ল আরে
আমার কাছেতো চৌধুরী সাহেবের
বাসার নাম্বার আছে! কি বোকাই না
আমি! উঠে দ্রুত ষ্টেশন মাষ্টারের
কক্ষের দিকে ছুটলাম। হতাশ হলাম,
কক্ষে তালা ঝুলছে। দুরে একজন
প্রহরীকে দেখলাম সিমেন্টের
বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে।
আবার আগের জায়গায় চলে এলাম।
কেন যেন বার বার মনে হচ্ছিল আমি
একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছি।
সারাটা রাত হয়ত আমাকে নিঘুর্ম
এখানে কাটাতে হবে। হাতঘড়ির
দিকে তাকাতেও বিরক্ত লাগতে
ছিল। নিজেকে অভিসাব দিয়ে
ভাবছিলাম কেন ঝোকের মাথায়
এভাবে চলে এলাম?
বিরক্তি কাটানোর জন্য চৌধুরী
সাহেবের অদেখা মেয়েটার কথা
ভাবতে লাগলাম। ইমরান বলছিল
মেয়েটার চেহারা নাকি অনেক
সুন্দর। মায়া ভরা মুখ। দেখলেই মনে
ভরে যাবে। গলার স্বরও নাকি খুব
মিষ্টি। ভাল রবীন্দ্র সংগীত গায়।
যাক বিকেলে বারান্দায় বসে কফি
খেতে খেতে ওর রবীন্দ্র সংগীত
শোনা যাবে।
চোখে তন্দ্রামত এসেছিল বোধহয়।
হঠাৎ নারী কণ্ঠের শব্দে চোখ খুলে
তাকালাম। আর তাকাতেই বিস্মিত
হলাম। আমার সামনে দাড়িয়ে আছে
অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। সেও
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল
শাড়িটা তাকে খুব মানিয়েছে। মনে
হচ্ছে স্বর্গের হুর ভুল করে মর্তে চলে
এসেছে। মায়াবি চেহারার দিকে
তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারতে
ছিলাম না। হাসনে হেনার তির্ব
গন্ধে সারা রুম ভরে গিয়েছে। তরুণী
কি হাসনে হেনার গন্ধযুক্ত কোন
পারফিউম ব্যবহার করেছে? তার ফর্শা
হাতের দিক তাকালাম। মেহেদি
দেওয়া হাতে কাচের চুড়ি।অদ্ভদ
ঘোরলাগা মুহূর্ত। সে বললো, আপনি
নিশ্চয় শফিক সাহেব, তাইনা?
আমি বললাম, হ্যা। কিন্তু আপনি কে?
আমি মেহজাবিন চৌধুরী। বাবা
আপনার জন্য যাকে পাঠিয়ে ছিল সে
অবিবেচকের মত চলে যাওয়ায় আমি
খুবই দুঃখিত। আমি গাড়ি নিয়ে
এসেছি। উঠুন। সে আমার দিকে
তাকিয়ে নির্দেশ করে।
বিস্মিত আমি কিছুটা ঘাবড়ে
গেলাম মেহজাবিন এর আচরনে।
এতরাতে একটি মেয়ে কি কওে
অচেনা এক পুরুষের জন্য গাড়ি নিয়ে
ষ্টেশনে আসে? আর গাড়ি থাকলে
তার বাবা কেন রিকশা পাঠিয়ে
ছিলেন? বুঝতে পারছিনা কি করবো।
আমার দ্বিধা দেখে বিরক্তি ভরা
কণ্ঠে বলে, কি হলো আসুন। আমার
হাতে সময় খুব কম।
ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে
মেহজাবিনকে অনুসরন করি।
পুরানো দিনের নীল রংয়ের একটি
জিপ গাড়ি। গাড়ির ভেতরের লাইট
নেই। সামনে হেড লাইটের আলোয়
মেহজাবিনকে দেখছি। অসিম শূন্যতা
মেয়েটার চোখে। কিছুটা
দুঃচিন্তাগ্রস্থ বলেও মনে হল।
মেয়েদের পাশে অনেক বার বসেছি,
কিন্তু আজ কেন জানিনা অন্যরকম
লাগছে। আমি বললাম, আপনাদের
এখানে কি বিদুৎ নেই? সে গভির
ভাবনায় ডুবে ছিল উত্তর দিলনা।
আমিও কথা বলার মত কিছু খুজে
পেলামনা। আমি তাকে প্রথম দেখায়
ভালোবেসে ফেলেলাম। কি আশ্চর্য
২৮ বছরের জীবনে এমনটা কখনো
ঘটেনি। এত সহজে কারো প্রেমে পড়া
যায় আমার ভাবনায় তা ছিলনা।
আমি খুবই আশ্চর্য! ইচ্ছে করছে এখুনি
তাকে বলি যে আমার কণে পছন্দ
হয়েছে। মেহজাবিন আপনাকে আমার
খুব ভাললেগেছে।
কিন্তু তাকি উচিৎ হবে? ব্যাপারটা
বেশ হাস্যকর হয়ে যাবে ,তাই ওপথে
না গিয়ে প্রশ্নকরি আপনাদের
বাড়িতে যেতে আর কতক্ষন লাগবে?
সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি
হেসে বললো, বেশি না আর পনেরো
মিনিট লাগতে পারে। আপনি নিশ্চয়
খুব ক্লান্তি অনুভব করছেন?
না না, তেমন নয়। তবে অন্ধকারে একা
বসে থাকার সময় বেশ ভয় পাচ্ছিলাম।
শহরের মানুষতো!
সে হাসলো শব্দ করে, বলেন কি?
ভুতের ভয় আছে আপনার?
না তেমনটা নয়। আসলে একা
ছিলামতো!
ও আচ্ছা।
সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
বিদুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি কমেছে।
বাতাস বইছে খুব। আমি ষ্টেশনে বসে
থাকা বিরক্তিকর সময় গুলো ভুলে
গেলাম। মেহজাবীনকে মনে হল
আমার বনলতা সেন। ইচ্ছে করছিল
সারারাত তার সাথে গাড়িতে বসে
থাকি। মনে মনে ইমরানকে ধন্যবাদ
দিলাম আর তখনি হঠাৎ করে মনে হল,
ইমরান বলেছিল চৌধুরী সাহেব তার
বড় মেয়ের জন্য পাত্র খুজছেন।
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মেহজাবীন কি
বড় না ছোট?
যদি ছোট হয়? তবে বড় মেয়ে রেখে
নিশ্চয় চৌধুরী সাহেব তার ছোট
মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। তেমনটা
হলে আমি না হয় মেহজাবিন এর জন্য
অপেক্ষা করবো। মনকে স্বান্তনা
দিলাম।
ভাবনায় ছেদ পড়ল মেহজাবীনের
কণ্ঠে ও বললো, নামুন আমরা চলে
এসেছি। ঝাকি দিয়ে থেমে গেল
গাড়িটা। সাথে সাথে হেড লাইট অফ
হয়ে গেল। ব্রিফকেসটা নিয়ে নিচে
নামলাম। আবছা আলোয় শ্যাওলা
পড়া পুরাতন আমলের বিসাল এক
লোহার গেট দেখলাম। ইটের তৈরী
বেশ চওড়া একটা রাস্তা দেখলাম।
এটা যে এককালে জমিদার বাড়ি
ছিল তা আধারের মাঝেও টের
পাওয়া গেল। মেহজাবীন বললো,
আপনি ভেতওে যান, বাবা আপনার
জন্য অপেক্ষা করছে।
আপনি?
আমি পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকবো।
বাবা যদি জানে ষ্টেশনে আপনাকে
আনতে গিয়েছিলাম তাহলে অনেক
বকা দিবে। উনি খুব রক্ষনশীল
স্বভাবের। সে হাসল। তার হাসিটা
বেশ অদ্ভুদ লাগতে ছিল। তাকিয়ে
দেখি জিপের ভেতর কোন ড্রাইভার
নেই। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। মুখ
শুকিয়ে গেল আমার। আমার ঘাবড়ে
যাওয়া বেশ উপভোগ করছে
মেহজাবীন। হিহি করে হেসে উঠল
সে। কি হলো যান, দরজায় কড়া নাড়–
ন।
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন
মেহজাবীন। হাসনে হেনার তির্ব
গন্ধটাও মিলিয়ে গেল। কাপা হাতে
দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তে লাগলাম।
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন
মেহজাবীন। হাসনে হেনার তির্ব
গন্ধটাও মিলিয়ে গেল। কাপা হাতে
দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তে লাগলাম।
আমার শরীরও কাপতে ছিল। পেছনে
তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল
কেউ একজন আমার পেছনে দাড়িয়ে
আছে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খখনো
হয়নি আর, তাই বেশ অস্বস্তিতে
ছিলাম। কি জানি হয়ত মেহজাবীন
আমাকে শহরের মানুষ পেয়ে ভড়কে
দিচ্ছে। ওর রহস্যময়ী আচরন আমাকে
দ্বিধায় ফেলে দিল। কেউ কি নেই
ঘরে? দরজায় পাল্লায় ক্রমাগত
আঘাত করছি, কোন সাড়া নেই?
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পায়ের
উপর কেউ একজন হাত রাখছে। বরফের
মত ঠান্ডা হাত। ভয়ে শিড়দারা শক্ত
হয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার করতে চাইলাম
কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের
হলোনা। হার্টফেল করার পূর্ব মুর্হূতে
বিকট শব্দে দরজা খুলে গেল। মুখের
উপর হারিকেন উচু করে ধরলো কেউ
একজন। হঠাৎ চোখে আলো পড়ায়
কিছুই দেখতে পাচ্ছিলামনা।
কোনমতে বললাম, আমি শফিক
আহমেদ ঢাকা থেকে আসছি। এটা কি
চৌধুরী বাড়ি?
এবার হারিকেন নিচে নামলো।
চৌধুরী সাহেব বললো, আহারে বাবা
আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
কি করবো যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছিল।
আসেন আসেন ঘরে আসুন। আমি বিব্রত
কন্ঠে বললাম, আমার পায়ের দিক
আলো ফেলুন কি যেন আমার পায়ে।
আলো ফেলতেই দেখি একটি বড়সড়
আকারের ব্যাঙ আমার পায়ের উপর
বসে আছে।
ঘরে ঢুকে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হল।
জমিদার বাড়ি এতদিন সিনেমা আর
নাটকে দেখেছিলাম কিন্তু বাস্তবে
যে তা আরো বেশি আর্কষনীয় হয় তা
বুঝলাম। দেয়ালে দু’নলা বন্দুক
ঝুলানো। দুটো তলোয়ারও সাজিয়ে
রাখা হয়েছে। হরিনের মাথা আর
বাঘের চামড়াও ঝুলানো আছে।
আসবাব পত্রগুলি আভিজাত্যর ছাপ
বয়ে বেড়াচ্ছে।
খাবার টেবিলে আরেক জন বৃদ্ধ
ভৃত্যকে পেলাম। চৌধুরী সাহেবও
বসলেন আমার সাথে কিন্তু তার
দু’মেয়ের কাউকেই ঘরে দেখলাম না।
মনটার ভেতর খুব টান অনুভব করছিলাম।
মেহজাবীন একবারের জন্য উকি
দিলেও পারতো। ধুর মেয়েটা যে
কিনা!
খাওয় দাওয়া শেষে কিছুক্ষন গল্প
করলাম চৌধুরী সাহেবের সাথে।
তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে তার বাবার
জমিদারীর সময়ের নানা ঘটনা বলতে
লাগলেন। তিনি জানালেন দেয়ালে
ঝুলানো বাঘটাকে তিনি নিজে
শিকার করেছেন। তার শিকারের
গল্পও শুনলাম। একবার তিনি অল্পের
জন্য বাঘের হাত থেকে বেচে গিয়ে
ছিলেন সে কথাও জানলেন তিনি।
তার গল্প শুনতে বেশ লাগতে ছিলেন।
কিন্তু রাত অনেক হওয়ায় তা
থামাতে হল। পরিস্কার বিছানায় গা
এলিয়ে দিলাম। ক্লান্ত ছিলাম বলে
খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম
ভাঙলো পরদিন সকাল ৯টায়।
কক্ষের সামনের বারান্দায়
দাড়ালাম। সামনের সুন্দর ফুলের
বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
অনেক ফুল ফুটেছে। বাতাশে ফুলের
মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। নানা
জাতের অসংখ্য ফুলের গাছ।
চারপাশের সবুজ গাছ পালা আর
পাখির কিচির মিচির শব্দ ভীষণ ভাল
লাগছিল। মুগ্ধ হয়ে অপরুপ প্রকৃতি
দেখতে ছিলাম।
হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত ধরলো।
চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা
নয় দশ বছরের একটা মেয়ে আমার
দিকে তাকিয়ে আছে।
কে তুমি? প্রশ্ন করতেই হাত ছেড়ে
দৌড়ে পালালো মেয়েটি। আমি
তার দৌড়ে যাওয়া দেখলাম। হেটে
সামনে যেতেই গতরাতের বৃদ্ধ
ভৃত্যটার সাথে দেখা হল। বয়স ৭০বছর
হবে। ভাল করে দিনের আলোতে তার
দিকে তাকালাম সে কাস্তে হাতে
বাগানের আগাছা পরিস্কার করছে।
বাগান ভরা ফুল, লাল নীল সবুজ ফুল।
একসাথে এত ফুল দেখিনি কখনো। বৃদ্ধ
একমনে কাজ করতে ছিল, কাছে গিয়ে
বললাম ঐ মেয়েটি কে?
সে চোখ তুলে তাকালো, তারপর
বললো, ওর নাম ময়না। আমার নাতি,
বোবা কথা বলতে পারেনা। ভয় পায়
ও সবাইরে ভয় পায়।
আমি প্রশ্ন করি এই বাগান কে গড়ে
তুলে ছিল? সে দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে
বললো মেহজাবীন। বৃদ্ধর কথাটা শুনে
ভাল লাগলো। তারমানে মেহজাবীন
ফুল খুব পছন্দ করে, না?
উত্তর না পেয়ে পেছনে তাকাতেই
দেখি বৃদ্ধ নেই। আমি সামনের দিকে
এগুতে থাকি। বিশাল বড় বাড়িটার
চারদিকে সবুজের সমরোহ আমাকে
মুগ্ধ করে। এমন বাড়িতে বিয়ে হলে
ভালই হবে। আজ নিশ্চয় চৌধুরী
সাহেবের কন্যাদ্বয়ের সাথে দেখা
হবে। আচ্ছা মেহজাবীন কি আমাকে
পছন্দ করেবে? কি জানি! নারী
হৃদয়তো বড় বিচিত্র। তাছাড়া
আমাকে তো কোন নারী কখনো
সেভাবে চায়নি। হালকা টেনশনও
ফিল করছিলাম।
কিছুদুর সামনে গিয়ে দেখলাম
বাগানের পাশে সুন্দর সান বাধানো
ঘাটের পুকুর। পুকুরে লাল রংয়ের
শাপলা ফুল ফুটে আছে। আর
স্বচ্ছজলের উপর মাছেরা হা করে জল
খাচ্ছে! না, বোধহয় অক্সিজেন
নিচ্ছে। তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ নয়নে,
হঠাৎ পেছন থেকে চৌধুরী সাহেবের
কণ্ঠ‘ বাবা তুমি এখানে আর আমি
সারা বাড়ি খুজতেছি। চল নাস্তা
খাবে।
হেসে বললাম পুকুরের মাছ দেখতে খুব
ভাল লাগতে ছিল। অপূর্ব!
পরে এসে বড়শি দিয়ে না হয় মাছ
ধরিও। আমি তাকে অনুসরন করে পিছন
পিছন যাচ্ছিলাম। ডান দিকে ঘুরতেই
টিনের চালের গ্যারেজের নিচে
একটা জীপ গাড়ি দেখে চমকে
উঠলাম। থমকে দাড়িয়ে জিপটাকে
ভাল করে পর্যাবেক্ষন করতে
লাগলাম। বিস্মিত হলাম যখন
দেখলাম গাড়িটার দুটো চাকা
খোলা, ব্যাকডালা ভাঙা। একটা
হেডলাইটও নেই। মরিচায় জর্জরিত
বডি। সিটের উপর পাখির মল মুত্র।
মনেহয় গত দুই এক বছর কেউ এটা ছুয়েও
দেখেনি। গতরাতে কি আমি এই
গাড়িতে চড়ে এসেছিলাম?
চৌধুরী সাহেব পিছন ফিরে বললো
কি হলো? কি দেখছো?
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম আপনার
এরকম গাড়ি কয়টা?
একটাইতো ছিল। এটা
এ্যাকসিডেন্টের পর আর সারিনি। ও
আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে।
তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম। গলা
দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছিলনা
বিস্ময়ে। কোনমতে বললাম
মেহজাবীনতো কাল রাতে…!
এবার চৌধুরী সাহেবের মুখটা
ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বিস্মিত নয়নে
আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন
তুমিও দেখেছো! দীর্ঘ নিঃশ্বাস
ফেলেন তিনি। তার চোখে জ্বল টলমল
করে।
সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,
মেহজাবীন ছিল আমার বড় মেয়ে। খুব
ভালবাসতাম ওরে আমরা। লেখা
পড়ায় খুব ভাল ছিল। অসাধারণ ছিল
ও। কিন্তু বেশি ভাল কিছু আল্লাহ
পৃথিবীতে বেশি দিন রাখেন না। এই
গাড়িটা ওর খুব প্রিয় ছিল। নিজে
ডাইভিংও শিখেছিল। আজ থেকে ছয়
বছর পূর্বের ঘটনা। সেদিন সন্ধায় ওর
বান্ধবীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল।
অনুষ্ঠান শেষ করে যখন ফিরতে ছিল
তখন বাইরে ছিল আষাঢ়ের বৃষ্টি।
রাস্তার অবস্থাও ভাল ছিলনা। একটা
ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে ড্রাইভার
নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খালে পড়ে যায়।
এ্যাকসিডেন্টে দু’জনই মারা যায়।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চৌধুরী
সাহেব। আমি নিবার্ক পাথরের
মূর্তির মত তার দিকে তাকিয়ে
থাকি। যন্ত্রনায় আমার গলার কাছে
আটকে যায় আমার খুব কাদতে ইচ্ছে
করে, কিন্তু পারিনা। হৃদয় ভাঙার
কষ্টযে এত কঠিন আমার জানা
ছিলনা। অসহয় দৃষ্টি মেলে দুমড়ে
মুচড়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে
তাকিয়ে থাকি।
তুমি কাদছো কেন?
কাল তাহলে মেহজাবীন আমাকে কি
করে ষ্টেশন হতে এবাড়িতে নিয়ে
এল?
কি বলছো তুমি! আঁতকে উঠে তিনি
বিস্ফোরিত নয়নে তাকান আমার
দিকে। আমি গত রাতের ঘটে যাওয়া
পুরো ঘটনা তাকে বলি। সব শুনে
নিশ্চুব হয়ে যায় চৌধুরী সাহেব।
কিছুক্ষন পরে বলেন, তোমার মত এমন
করে অনেকেই তাকে দেখেছে। তবে
আমি তা বিশ্বাস করিনি। আজ করছি।
প্রতি বছর আষাঢ় মাস এলেই নাকি
ওরে জীপগাড়ি নিয়ে ঘরতে দেখা
যায়।
চোখ মুছে তিনি জীপ গাড়িটার
দিকে তাকিয়ে বলেন, আর মায়া
করে লাভ নেই। অভিসপ্ত গাড়িটাকে
বিক্রি করে দিতে হবে।
তাই ভাল হবে। মাথা নিচু করে তার
পেছন হাটতে হাটতে বলি।

No comments:

Post a Comment