Friday, April 17, 2015

ভুতের গল্প - ৯

একইভাবে খুন হয়ে যেত সবাই-
প্রত্যেকের
ঘাড়ে থাবার চিহ্ন। দানব দশটা নখ
বসিয়ে দিতো শিকারের ঘাড়ে।
শুরুতে মানুষ
নয়, ছোটখাট প্রাণী দানবটির শিকার
হচ্ছিল। একদিন সকালে এক কৃষক ঘুম
থেকে উঠে দেখে তার তিনটা ছাগল
রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে রয়েছে।
এরপরে গাঁয়ের
তিনটে পোষা কুকুরকে মৃত
অবস্থায় পাওয়া যায়। সবার
ঘাড়ে অদ্ভুত
থাবার চিহ্ন।গুজব
ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।
প্রাণীগুলোর অন্তিমদশার
কথা জানে সবাই। কিন্তু কেউ
বলতে পারে না কীভাবে মারা গেল
জানোয়ারগুলো। একটি বাছুরও
রক্তক্ষরণে মারা গেল। নিরীহ
প্রাণীটির
ঘাড়ে শিরা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে দশ
আঙুলে। ঘাড়ে দশটি ধারাল নখের
চিহ্ন।
এরপর সাবধান হয়ে গেল গ্রামবাসী।
বিছানার পাশে দা-কুড়াল-খন্তা
রেখে তারা ঘুমাতে লাগল। গোয়াল
ঘরে তালা মেরে রাখা হলো পোষা জন্তুদের।
গোটা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।
নানানজনে নানান গল্প
বানাতে লাগলো।
একে অন্যের দিকে তারা সন্দেহের
দৃষ্টিতে তাকায়।
এরপরে ঘটল সেই ঘটনা-
যে ভয়টা এতদিন
সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। দানব
হামলা চালালো মানুষের ওপর।
আক্রমণের
শিকার হলো মাতাল জমির উদ্দিন।
একদিন
সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল
তাকে।
ঘাড়ে দশটা নখ বসানো চিহ্ন। গর্ত
হয়ে আছে। কুকুর, ছাগল এবং বাছুরের মত
একই
পরিণতি হয়েছে তার। প্রবল
রক্তক্ষরণে মারা গেছে। তিন
কুলে যার কেউ
নেই সেই ভবঘুরে জমির উদ্দিনের
মৃত্যুতে গাঁয়ের মানুষ শোক প্রকাশ
করলো না,
তবে ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেল
সবার। কারণ সবাই জেনে গেছে মানুষ
শিকারেও অরুচি নেই দানবের।
যে কেউ তার
শিকার হতে পারে।
ভীত-সন্ত্রস্ত
গ্রামবাসী এবারে গড়ে তুললো একটি স্বেচ্ছাসেবী দল।
তারা রাতের বেলা পালা করে গ্রাম
পাহারা দেবে। তবে মুশকিল
হলো কেউ
জানে না কীসের
বিরুদ্ধে তারা লড়াই
করছে।
লিটু আর টিটু নামে দুই
ভাইকে করা হলো সেচ্ছাসেবী দলের
নেতা।
এরা গাঁয়ের সবচেয়ে সাহসী দুই তরুণ।
একমাত্র এদের বাড়িতেই দু’টি বন্দুক
আছে।
বন্দুক
দিয়ে তারা মাঝে মাঝে গাঁয়ের
পাশের জঙ্গলে শিকার করে। আর
এদের
বাড়ি জঙ্গলের ধারেই। এবং লোকের
ধারণা দানবটা জঙ্গলেই
আস্তানা গেড়েছে। ওদের
বাছুরটাকেই
মেরে ফেলেছে দানব।
সেচ্ছাসেবী দল গঠন হওয়ার পরে লিটু-
টিটু
বাড়ি গেল
কীভাবে রাতে পাহারা দেবে তা নিয়ে আলোচনা করতে।
শীতের রাত। তাই রান্নাঘরে উনুন
জ্বেলে বসলো দুই ভাই। ওদের মা নেই।
বাবা আছে। আর বুড়ি দাদী।
দাদী প্রায়
বেশিরভাগ সময় চুলোর
পাশে বসে থাকে গায়ে কালো একটা চাদর
জড়িয়ে। উনুনের উত্তাপে শরীর গরম
রাখে।‘আজ রাত থেকেই শুরু পাহারা,’
নিচু
গলায় বলল বড় ভাই লিটু।
‘দলনেতা হিসেবে আমাদের ওপর এ
দায়িত্ব
বর্তেছে। তা ছাড়া অন্যরা এখনই
পাহারায়
যেতে ভয় পাচ্ছে।’
‘হুঁ,’ সায় দিল ছোট ভাই টিটু। ‘ওটা-যাই
হোক
না কেন-প্রতি পাঁচদিন পরপর
হামলা চালায়। জমির উদ্দিন
মারা গেছে আজ পাঁচদিন হলো। আজ
রাতে আবার
ওটা হামলা চালাতে পারে।
কাজেই আজই পাহারা বসাতে হবে।’
‘তোরা পাহারা দিতে যাচ্ছিস যা,’
বলে উঠলো ওদের বাবা।
‘তবে কিসের সঙ্গে টক্কর
দিবি সে কথা মনে থাকে যেন।
ওটা কিন্তু
আকস্মিক হামলা চালায়। এ পর্যন্ত
যে ক’টা হামলা হয়েছে, ধস্তাধস্তির
কোনও
চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কাজেই খুব
সাবধান।
আম্মা, আপনি কি বলেন ?
চুলোর পাশে বসা দাদী তাঁর ছেলের
দিকে একবার চোখ তুলে চাইলেন। কেন
জানি শিউরে উঠলেন। তারপর আবার
মুখ
নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন জ্বলন্ত
চুল্লির
দিকে।
ওরা তিনজন নিজেদের আলোচনায়
ফিরে গেল। বুড়ির কাছ থেকে অবশ্য
কোনও
জবাব আশাও করেনি। কারণ
দাদী স্বল্পবাক
মানুষ। তা ছাড়া বেশ ক’বছর ধরে তাঁর
মাথারও ঠিক নেই। হঠাৎ হঠাৎ
উল্টোপাল্টা সব কাজ করে বসেন।
লিটু তাদের পরিকল্পনার
কথা জানালো বাবাকে। ‘আমি আর
টিটু আজ
রাতে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে যাব।
তবে জঙ্গলে ঢুকব না। জঙ্গল আর গাঁয়ের
মাঝখানের রাস্তায় পাহারা দেব।
দানবটা যদি আসেই আমাদের চোখ
এড়িয়ে গাঁয়ে ঢুকতে পারবে না।’
‘তোরা পাহারা দিবি কিভাবে?’
জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বাবা।
‘আমরা একজন আরেকজনের ওপর নজর
রাখব,’
জবাব দিল লিটু। ‘হাঁক-চিৎকার
দিলে শোনা যায় এরকম দূরত্বে থাকব
দু’জন।
জঙ্গলের দিকে চোখ
থাকবে আমাদের। দানব
যদি সত্যি জঙ্গলে থাকে,
বেরুনো মাত্র
ওকে গুলি করব।’
‘কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতেই
হবে.’ টিটু বললো তার বাবাকে।
‘জানি না দানবের পরবর্তী শিকার
কে হবে,
তবে হাত-পা গুটিয়ে অসহায়ের
মতো আর
বসে থাকা যায় না।’
বাবা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুই
ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো বুকে।
‘বেঁচে বর্তে ফিরে আসিস, বাপ।’
বাষ্পরুদ্ধ
কণ্ঠে বলল সে।
লিটু দেয়ালে ঝোলানো বন্দুক
জোড়া নামাল। টিটু কাঠের সিন্দুক
খুলে ধারাল দু’টি রাম দা বের করল।
একটা দিল বড় ভাইকে। নিজের
কাছে রাখল
অন্যটা। তারপর দাদীকে সালাম
করে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে।
বাইরে ঘোর অন্ধকার।
পশ্চিমাকাশে কাস্তের মত
একফালি বাঁকানো চাঁদ।
পুবর্দিকে পা বাড়াল দুই ভাই। ওদিকেই
জঙ্গল। ওরা যেখানটাতে পাহারায়
দাঁড়াবে ভেবেছে,
কাছাকাছি আসতে ফিসফিস করল টিটু,
‘ভাবছি ওটা দেখতে কেমন।’
‘আমিও একই কথা ভাবছি, ‘বলল লিটু।
‘হয়তো কোনও দানব পাখি-টাখি হবে।
সাঁৎ
করে আকাশ থেকে নেমে এসে ঘাড়ের
শিরা ছিঁড়ে পালিয়ে যায়।’
দু’জনেই আকাশে তাকাল। পাতলা, সরু
চাঁদটিকে ঘিরে আছে মেঘ। আকাশ
থেকে কিচু উড়ে এলেও আঁধারে ঠাহর
করা যাবে না।
‘ওটা মাটির নিচের কোনও প্রাণীও
হতে পারে,’ মৃদু গলায় মন্ত্রব্য করল টিটু।
‘মাটিতে গর্ত খুঁড়ে থাকে। সুযোগ
বুঝে হামলা চালিয়ে বসে পেছন
থেকে।’
ছোটভাইয়ের কথা শুনে গা কেমন ছমছম
করে ওঠে বড়ভাইয়ের। পেছন
ফিরে তাকায়
সে। দেখাদেখি টিটুও। কিন্তু নিকষ
আঁধারে কিছুই দেখা যায় না।
অনেকক্ষণ
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল দুই ভাই।
শেষে নীরবতা ভাঙল লিটু। ‘চল,
যে যার
জায়াগায় গিয়ে দাঁড়াই।
তবে বেশিদূর
যাসনে। হাঁক ছাড়লেই যেন
সাড়া পাই।’
দু’ভাই দু’দিকে চললো।
লম্বা লম্বা চল্লিশ
কদম ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অন্ধকারে বন্দুকে গুলি ভরল লিটু।
তারপর
রামদা’টা নরম মাটিতে পুঁতল। রামদা’র
পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
চল্লিশ কদম দূরে, অন্ধকারে ভীত
ভঙ্গিতে বন্দুকে হাত বুলাচ্ছে টিটু।
তার
হাত কাঁপছে।
এতদিন জঙ্গলে খরগোশ, বুন
বেড়াল এবং বন মোরগ ছাড়া কিছু
শিকার
করেনি। সাহস বলে যতই নাম-ডাক
থাকুক,
ভূতের ভয় তার বেজায়। স্রেফ লজ্জায়
না বলতে পারেনি। বাধ্য
হয়ে আসতে হয়েছে পাহারায়।
দানবটা ভূত-
প্রেত হতে পারে। নইলে তাকে কেউ
এতদিন
দেখতে পায়নি কেন? ভূতের
বিরুদ্ধে কি বন্দুক দিয়ে লড়াই
করা চলে? আর
ওটা যদি ভূত না-ও হয়, ভয়ঙ্কর কোনও
জন্তুও হয়,
প্রয়োজনের সময় বন্দুক
চালাতে পারবে তো সে? বড়
ভাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করল লিটুর।
কিন্তু
ঝোপ এবং গাছের গাঢ় ছায়া যেন
গিলে খেয়েছে লিটুকে।
দেখা যাচ্ছে না।
ঘুরলো টিটু। তাকালো গাঁয়ের দিকে।
ইস্,
কেন যে মরতে মীটিং-এ সবার
সামনে বড় বড়
কথা বলেছিল। বাবার সামনেও
হামবড়া ভাব
দেখিয়েছে, যেন কিছু গ্রাহ্য
করছে না।
পেছনে টাশ্শ্ শব্দে একটা মরা ডাল
ভাঙল।
চরকির মত সরল টিটু। কিন্তু কিছুই
চোখে পড়ল
না, আর কোনও শব্দও শোনা গেল না।
পেশীতে ঢিল পড়ল টিটুর। বন্দুকের
কুঁদো ঠেকাল মাটিতে, হেলান দিল।
ঘুম ঘুম
আসছে।
আর ঠিক তখন ঘাড়ে সুচের মত তীক্ষ্ণ
ব্যথা ফুটল। কেউ ওর গলায় ধারাল
নখের
থাবা বসিয়েছে।
তীব্র, তীক্ষ্ণ আর্ত-
চিৎকারে ভেঙে খানখান
হয়ে গেল বনভূমির নিশি-নৈঃশব্দ্য।
লাফিয়ে উঠল লিটু। ওর ভাইয়ের
গলা না? এক
হাতে বন্দুক, অপর
হাতে রামদা নিয়ে চিৎকারের উৎসের
দিকে ছুটল ও। কিন্তু গাঢ়
অন্ধকারে কিছুই
দেখা যাচ্ছে না।এমন সময় টিটুর
ঘরঘরে গলা শুনতে পেল টিটু।
গোঙাচ্ছে।
গোঙানি লক্ষ্য করে ছুটল ও। আরও স্পষ্ট
হয়ে উঠল গোঙানি।
ভাইকে দেখা যাচ্ছে না তবে ওর বেশ
কাছে এসে পড়েছে লিটু
বুঝতে পারছে।
বন্দুকটা ফেলে দিল ও।
অন্ধকারে গুলি করলে টিটুর
গায়ে গুলি লাগতে পারে।
দু’হাতে রামদা ধরে মাথার ওপর বনবন
করে দু’পাক ঘোরাল লিটু। কিছু একটার
সঙ্গে বাড়ি খেল ধারাল ফলা। রক্ত
জল
করা একটা চিৎকার শুনল লিটু। গা হিম
হয়ে গেল ওর। টিটুর লাগেনি তো? ও
তো আর
গোঙাচ্ছেও না।
অন্ধকারে হয়তো রামদার
কোপ ভাইয়ের গায়ে লেগেছে।
মারা গেছে সে। বুক ফেটে কান্না এল
লিটুর।
এমন সময় আবার গোঙাতে শুরু করল টিটু।
স্বস্তির পরশ ঝিরঝির করে নামল লিটুর
শরীরে। নাহ্, ওর ভাই মারা যায়নি।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেল লিটু।
মরা পাতার ওপর
দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কিছু
একটা খচমচ শব্দ তুলে। ধেড়ে ইঁদুর-টিদুর
হবে হয়তো। তবে ওটাকে দেখতে পেল
না লিটু। সে আন্দাজে ভাইয়ের
পাশে এসে বসল। তখন মেঘের আড়াল
থেকে বেরিয়ে এল ক্ষীণকায় চাঁদ।
তার
অতি অল্প আলোয় টিটুর
দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল লিটু।
টিটুর
ঘাড়ে গেঁথে আছে চিমসানো একটা কাটা হাত।
কাটা কনুই থেকে রক্ত ঝরছে। হাতটার
আঙুলে বড় বড় ধারাল নখ।
নখগুলো খামচে ধরে আছে টিটুর
কাঁধসহ ঘাড়।
অন্ধকারে রামদার পোপে এ হাতটাই
কেটে ফেলেছে লিটু। সময় মত
এসে পড়ায়
রক্ষা পেয়েছে টিটু। কাটা হাতের
মায়া ত্যাগ করেই
পালাতে হয়েছে দানবকে।
লিটু টিটুর ঘাড় থেকে টান
মেরে ছুটিয়ে আনল কাটা হাত। নখের
আঘাতে গর্ত হয়ে গেছে ঘাড়ে। রক্ত
ঝরছে।
ক্ষতস্থানে রুমাল বেঁধে দিল লিটু।
তারপর
ভাইকে নিয়ে রওনা দিল গাঁয়ে।
কাটা হাতটা পড়ে রইল জঙ্গলে।
ওদের বাবা ভয়ার্ত
শুকনো মুখে অপেক্ষা করছিল দোর
গোড়ায়।
ছোট ছেলের চিৎকার শুনতে পেয়েছে।
দু’ছেলেই
বেঁচে আছে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো সে।
টিটুকে খাটিয়ায় শুইয়ে দিল ওরা।
ডেটল আর
পানি দিয়ে পরিস্কার করল ক্ষতচিহ্ন।
আর
কয়েক সেকেণ্ড দেরী করলেই খবর
হয়ে যেত
টিটুর। ওকে জ্যান্ত ফিরে পেত
না লিটু।
ভাইয়ের ঘাড়ে ব্যাণ্ডেজ
করতে করতে দানবের কথা ভাবছিল
লিটু।
কাটা হাত
নিয়ে রক্তক্ষরণে ধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলেই
হয়তো মরে পড়ে থাকবে দানবটা।
আহত টিটুকে নিয়ে লিটু এবং তার
বাবা এত
ব্যস্ত ছিল যে খেয়াল করেনি চুল্লির
পাশে দাদী নেই। দাদী যে খিড়কির
দরজা দিয়ে আবার
রান্নাঘরে ঢুকেছেন তাও
লক্ষ করেনি কেউ। দাদী কাঠের
পিঁড়িতে বসে শীতল, ক্রুর চোখে দুই
নাতির
দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কেউ শুনল না তাঁর অসংখ্য ভাঁজ
পড়া মুখ
থেকে হিসহিস শব্দ বেরিয়ে আসছে।
এবং কেউ দেখল না কালো চাদরের
নিচে তিনি রক্তাক্ত
একটি মাংসপিণ্ড
লুকিয়ে রেখেছেন।

No comments:

Post a Comment